দেশে প্রশাসন, পুলিশসহ সার্বিকভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের যে জনমত গড়ে উঠেছে, তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন।
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে দলটি অন্তর্বর্তী সরকারের সব বিষয়ে তাদের সমর্থন থাকার কথা জানিয়েছে। একই সঙ্গে বিএনপি নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চেয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া অন্য দলগুলোরও সরকারকে সময় দিতে আপত্তি নেই বলে জানা গেছে। তবে দলগুলোর নেতারা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তাঁদের বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। ছাত্রদের আন্দোলনের সময় হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং ভেঙে পড়া পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসনে সংস্কারের বিষয়ে মূলত তাঁরা আলোচনা করেছেন। আর এ ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সময় প্রয়োজন। দলগুলো তা বিবেচনায় নিচ্ছে। তবে কত দিন সময় দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলছে না দলগুলো।
গতকাল সোমবার বিকেল চারটা থেকে ঢাকায় হেয়ার রোডে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বিভিন্ন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে তাঁর সঙ্গে আরও পাঁচ উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা হলেন অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ফরিদা আখতার, আদিলুর রহমান খান, নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিন পর শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এরপর গতকালই প্রথম রাজনৈতিকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে সরকার।
প্রধান উপদেষ্টা গতকাল বিকেল চারটায় প্রথম বৈঠক করেন বিএনপি নেতাদের সঙ্গে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেখানে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলিনি। আগেও বলেছি, নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে কিছু সময় লাগবে। আমরা তাদের অবশ্যই সেই সময় দিচ্ছি। আমরা তাদের সব বিষয়কে সমর্থন দিচ্ছি।’
বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমরা একটা কথা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি, বর্তমানে দেশে যে অস্থিরতার চেষ্টা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা, সাম্প্রদায়িকতার ধোয়া তোলা হচ্ছে, এগুলোতে জনগণ যাতে বিভ্রান্ত না হন। জনগণ যাতে আগের মতো ধর্মীয় সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রেখে, জনগণের নিরাপত্তাকে অক্ষুণ্ন রেখে সরকারকে সহায়তা করেন। আমরা পুরোপুরিভাবে সেভাবে সহায়তা করছি।’
বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির অন্য একাধিক নেতা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে অন্তর্বর্তী সরকার একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবে। কীভাবে রাষ্ট্রের সংস্কার করা হবে, কত দিন সময় লাগবে—কর্মপরিকল্পনায় এসব বিষয় থাকতে পারে।
তবে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে এই বৈঠকের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বৈঠকে বিএনপির অন্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ।
বিকেলে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের পরপরই জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে দলটির কয়েকজন নেতা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রবেশ করেন। এরপর তাঁদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ও পাঁচ উপদেষ্টা বৈঠক করেন। জামায়াতে ইসলামীও রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারকে সহায়তা করতে প্রস্তুত বলে আশ্বস্ত করেছে। একই সঙ্গে তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানও বলেন, নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। তিনি যোগ করেন, ‘ওনারা কেবল বসলেন। মাত্র চারটা দিন হলো। আমরা ওনাদের দেখতে চাই যে ওনারা কীভাবে জাতিকে নিয়ে এগোতে চাচ্ছেন। সমস্যাগুলোর আশু সমাধান কীভাবে করেন। এগুলো যৌক্তিক সময়ে সমাধান হবে বলে আমরা আশাবাদী।’
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগ নিয়েও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দলগুলোর বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের আমির ঘটনাগুলোকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘এটা সত্য, আমাদের এখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী যাঁরা আছেন, তাঁদের ওপর বিভিন্ন জায়গায় কিছু হামলা হয়েছে। হামলাটা ধর্মীয় কারণে হয়েছে, নাকি রাজনৈতিক কারণে হয়েছে, এটা খুঁজে বের করতে হবে।’
বিএনপি–জামায়াত ছাড়াও গতকাল গণতন্ত্র মঞ্চ, সিপিবি, বাসদ, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, এবি পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ও গণ অধিকার পরিষদের দুই অংশের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। এসব দলও সরকারকে রাষ্ট্র সংস্কারে সময় দেওয়া ও সব ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের দিন ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হবে কি না, সে বিষয়ে আলোচনায় ভিন্ন ভিন্ন মত এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, কোনো কোনো দল ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস বাতিল করার কথা বলেছে। আবার কোনো কোনো দল জাতীয় শোক দিবস বাতিল না করার পক্ষে মত দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার এ বৈঠকের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও এর মিত্র ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। ফলে তাদের সঙ্গে আলোচনা হবে কি না, তা এখনো জানা যায়নি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়লে বিএনপি–জামায়াতসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও তিন বাহিনীর প্রধান। ওই আলোচনায়ও আওয়ামী লীগ কিংবা তাদের মিত্র দলের কাউকে রাখা হয়নি।